অবৈধ বাংলাদেশি’দের নাম ভোটার তালিকায় তুলতে মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক দল সুপারিশ করেছে বলে অভিযোগ করেছেন ভারতের কেন্দ্রীয়মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। তিনি বলেন, সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিনের (এমআইএম) নেতাদের নাম ছাপানো প্যাডে অবৈধ বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। গত বুধবার হায়দরাবাদ নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে ভারতীয় একটি টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে তিনি এ কথা বলেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ও বেআইনিভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জায়গা দেওয়ার জন্য হায়দরাবাদের সংসদ সদস্য এমআইএমের প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি এবং তেলেঙ্গানা সরকারকে দায়ী করেছে বিজেপি। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ থেকে কথিত অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টি বিজেপি নেতারা ভোটের ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেন। এবার সুদূর দক্ষিণ ভারতের হায়দরাবাদ শহরের পৌর নির্বাচনেও এ প্রসঙ্গ তোলা হলো।
বিজেপির তেলেঙ্গানা রাজ্য সভাপতি ও সংসদ সদস্য বান্ডি সঞ্জয় এক নির্বাচনী সভায় বলেন, আমাদের
দল পৌরসভা নির্বাচনে জিতলেই রোহিঙ্গা ও পাকিস্তানিদের এক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে পুরনো হায়দরাবাদ শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি ও এমআইএম রোহিঙ্গা, পাকিস্তানি ও আফগানদের ভোট পেয়ে নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
আরেকটি জনসভায় এমআইএমের প্রধান ও হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বান্ডি সঞ্জয়ের এ অভিযোগের জবাব দেন। তিনি বলেন, বিজেপির অভিযোগ হায়দরাবাদে ভোটার তালিকায় নাকি ৩০-৪০ হাজার রোহিঙ্গা আছে। যদি ৩০ হাজার রোহিঙ্গা হায়দরাবাদে থাকে, তা হলে অমিত শাহ কী করছেন? তিনি কি ঘুমিয়ে আছেন? তিনি তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ৩০-৪০ হাজার রোহিঙ্গার নাম ভোটার তালিকায় কীভাবে এলো তার তো সেটা দেখার কথা।
এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই গত বুধবার হায়দরাবাদে দলের প্রার্থীদের হয়ে প্রচারে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, একটি স্থানীয় টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়েছে, ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য এমআইএম ও তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে একজন রোহিঙ্গা মুসলিম কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। একটি জাতীয় চ্যানেলের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, এমআইএম নেতাদের নাম ছাপা প্যাডে চিঠি লেখা হয়েছে, যাতে অবৈধ বাংলাদেশিদের নাম ভোটার তালিকায় তোলা হয়।
৭-৮ বছর ধরে হায়দরাবাদে ১২শ থেকে ১৩শ রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবার বসবাস করছে। তাদের ৭৫ শতাংশই বেসরকারি জমিতে ঝুপড়ি ঘর তুলে বাস করছে। তারা সবাই শ্রমিক। নূর বাশার তাদেরই একজন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী আমাদের কাছে এসে কখনই বলেনি, দলে এসো, তোমাদের নাগরিকত্ব পাইয়ে দেব বা ভোটার তালিকায় নাম তুলে দেব। কিন্তু কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে এ রকম খবর দেখানো হয়েছে।
তিনি বলেন, সমস্যাটা আসলে ভাষার। শরণার্থীদের বেশিরভাগই স্থানীয় ভাষা বোঝে না। আর আমার সামনে একবার সংবাদকর্মীদের কিছুটা রাজনৈতিক প্রশ্ন করতে দেখেছি। সাংবাদিক কাউকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনার নাম ভোটার লিস্টে আছে?’ কোনো শরণার্থী বলে দিয়েছে ‘হ্যাঁ’। আবার প্রশ্ন করেন, ‘এ জন্য কি এমআইএম ও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আপনি কৃতজ্ঞ?’ তিনি আবার বলছেন, ‘হ্যাঁ’। আসলে ওই শরণার্থী প্রশ্নটাই বুঝতে পারেননি!
রোহিঙ্গারা জানান, তাদের প্রায় সবারই জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে দেওয়া পরিচয়পত্র আছে। যাদের সেই পরিচয়পত্র নেই, তাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। প্রাপ্তবয়স্ক হলেই এ পরিচয়পত্র পাওয়া যায়।
হায়দরাবাদের ইংরেজি দৈনিক ডেকান ক্রনিকালের রেসিডেন্ট এডিটর শ্রীরাম কারি বলেন, তিন বছর পরের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়েই এখন রাজ্য সরকারকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে বিজেপি। সে জন্যই তারা হিন্দু-মুসলিম প্রসঙ্গ সামনে এনে বিভাজনের চেষ্টা করছে। আর পুরনো হায়দরাবাদ শহর, যে অঞ্চলটি রাজনৈতিকভাবে আসাদুদ্দিন ওয়েইসির এমআইএম নিয়ন্ত্রণ করে সেখানেই এ তত্ত্ব চালানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, এমআইএম অবৈধভাবে বাস করা পাকিস্তানি, বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে।
শ্রীরাম কারি আরও বলেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যের। পৌরসভা নির্বাচনে ইস্যু হওয়ার কথা রাস্তা, আলো, পানি ও চিকিৎসা। কিন্তু এসবের বদলে বহু দূরের একটা ইস্যু নিয়ে আসা হলো।
এদিকে বিজেপি নেতাদের তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকির পরও রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সে রকম বিচলিত নন। তারা বলছেন, তাদের সবার কাছেই জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের দিল্লি দপ্তর থেকে দেওয়া বৈধ নথি রয়েছে। তাই ভারত সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই তারা মেনে চলবেন।