একজন ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করলাম – দেশে এত এত শিক্ষিত জনবল থাকতে কেন আপনারা বিদেশী ম্যানেজার নিয়ে আসছেন ? তা-ও আবার প্রতিবেশি দেশ থেকে ? তাদের দক্ষতা কি আমাদের দেশের জনবলের চেয়ে বেশি ? না-কি অনেকে যা বলেন- ফ্যাশন ? তিনি বল্লেন – দেখুন, আমি আমার কোম্পানীতে একজন বিদেশী ম্যানেজার রেখেছি। বেতন ও সুযোগ সুবিধা মিলিয়ে তার জন্যে আমার মাসিক খরচ কমপক্ষে বারো লক্ষ টাকা। আপনি যদি আমাকে একই দক্ষতার দেশি একজন ম্যানেজার দিতে পারেন আমি তার জন্যে মাসে পনের লক্ষ টাকা খরচ করতে রাজী আছি। আমরা ব্যবসা করি উন্নতি আর লাভের জন্যে। কর্মচারীদের চেহারা দেখার জন্যে না। প্রতিষ্ঠানের প্রোডাক্টিভিটি না বাড়লে কেবল দেশপ্রেমের জন্যে কি কেউ লোকসান গুনতে রাজী হবে ! ব্যবসায় বানিজ্যের উন্নতি মানে তো দেশেরও উন্নতি। বিদেশী ম্যানেজার নিয়োগ দেয়ার পর আমার বরং অযথা খরচ কমে টার্ণওভার বেড়েছে অনেক। অদক্ষ আর অপেশাদার কর্মচারীদের পেছনে এর আগে অযথা ব্যয় করে একসময় মনে হয়েছে এরা বরং প্রতিষ্ঠানের জন্যে কাউন্টার-প্রোডাক্টিভ ছিলো। দেশের জব-মার্কেট দক্ষ ও পেশাদার লোকের তীব্র সংকট চলছে। এদের কমিটমেন্টের যায়গাটা খুব দুর্বল।
কয়েকদিন ধরে নিজস্ব কিছু কারিগরি উদ্ভাবনী কাজের প্রয়োজনে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে হাল্কা ও ক্ষুদ্র শিল্প এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ধোলাইখাল এমন কি ঢাকার বর্ধিত জনপদে গড়ে উঠা এধরনের অসংখ্য ছোট ছোট সংযোজন ও ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প ও তাদের কার্যক্রম দেখে রীতিমতো হতবাক হয়েছি। এদেশেই বিপুল পণ্যসামগ্রী, যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, নির্মাণ ও ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের সহায়ক অসংখ্য উপকরন তৈরী হচ্ছে। অন্যদিকে বেশ কিছু জরুরী হোম এপ্ল্যায়ান্স বিদেশ থেকে আমদানি প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। অথচ এক দেড় দশক আগেও দেশ এসবে শতভাগ আমদানি-নির্ভরতা ছিলো। ফ্রিজ, টিভি, এয়ারকন্ডিশনারসহ বিপুল সংখ্যক ইলেকট্রনিক ও গৃহসামগ্রী দেশে তৈরী হচ্ছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস, জুতা ইত্যাদি রপ্তানী-প্রধান শিল্পের বিভিন্ন উপকরন তৈরীর অনেক পশ্চাদ-শিল্প গড়ে উঠছে। এসবে দক্ষ ও কারিগরিজ্ঞান সম্পন্ন লোকের ব্যাপক চাহিদা আছে কিন্তু উপযুক্ত কর্মীর অভাব প্রকট বলে উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন। গার্মেন্টস কারখানাগুলোর সামনে ও আশেপাশে পোষ্টার, ব্যানার টাঙ্গিয়ে অভিজ্ঞ কর্মীর চাহিদা বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। অফিস ব্যবস্থাপনা, আইটি, বাস্তু নির্মাণ-শিল্পেও কর্মীর অভাব। গ্রামে কৃষি-কর্মীর অভাব।
অথচ এর উল্টা দিকে হু হু করে বাড়ছে কথিত শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। ইতোমধ্যেই বেকারত্ব তীব্র আকার ধারন করেছে। এবং অদূর ভবিষ্যতে তা গভীর সংকটে রূপ নেবে এমন আশংকা করা যায়।
দেশে শিক্ষিতের হার বেড়েছে। উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেটধারীদের সংখ্যা বাড়ছে আশংকাজনকভাবে – যাদের শিক্ষা অত্যন্ত নিন্মমানের। এরা হন্যে হয়ে ‘চাকুরী’ নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটে ব্যর্থ হতোদ্যম হতাশ ও অকর্মণ্য হয়ে নিজ, পরিবার ও দেশের জন্যে বোঝা হয়ে উঠছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিন্মমানের ডিগ্রিধারী এসব তরুণ যুবকেরা শ্লাঘা-বোধ থেকে শ্রমঘন কর্ম-বিমুখ হয়ে থাকে। সবার চাই চাকুরী। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায়োগিক, কারিগরি, উদ্ভাবনমূলক বা উদ্যোক্তা তৈরীর শিক্ষা দেয়া হয়না। যেটুকুই বা হয় তার যথাযথ কর্মক্ষেত্র তৈরীর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়না।
নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার কাছে বিভিন্ন সময় অনেক শিক্ষিত, গ্র্যাজুয়েট চাকুরী-প্রার্থী আসতো কোন একটা চাকুরীর সুপারিশ করে দেয়ার জন্যে। এরকম বেশ কয়েকজন বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী পাবার পর উভয়পক্ষের অভিযোগ অনুযোগে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হলো। চাকুরের অভিযোগ – বেতন কম, খাটুনি বেশি, তার উপর বকাঝকা শুনতে হয়। যেন আরেকটা চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেই। অন্যদিকে নিয়োগকারীর অভিযোগ -কর্মচারী অকর্মণ্য, অদক্ষ, আদৌ কোন কাজের যোগ্য না।
এরপর চাকুরীপ্রার্থীদের নিজেই একটা ইন্টারভিউ নেয়ার কৌশল অবলম্বন করলাম। এখানেই আমার চরম বিষ্মিত হবার ঘটনা শুরু। একজন এমবিএ পাশ দাবীকারীকে জিজ্ঞেস করলাম “এমবিএ” র পূর্ণ রূপ কি? তিনি বিব্রতভাবে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর তোতলাতে শুরু করলেন। পারলেন না। একজন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী ইংরেজিতে “এসএসসি” র পূর্ণরূপ লিখতে গিয়ে তিন শব্দের প্রতিটির বানান ভুল করলেন। একজন খুব চমৎকার সিভি বানিয়ে আনলেন। তাঁর সিভির কয়েকটি শব্দ লিখতে দিলাম। প্রত্যেকটা বানান ভুল। স্বীকার করলেন যে সিভি কম্পিউটারের দোকানী তৈরি করে দিয়েছে। এরকম বহু গ্র্যাজুয়েটকে পরীক্ষা করে চরম হতাশ হতে হয়েছে।
বিষ্ময়কর হলো এদেশে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে টেকনিক্যাল শিক্ষার তেমন উপযুক্ত শিক্ষা পরিকল্পনা বা প্রতিষ্ঠান নেই বল্লেই চলে। নির্মাণ শিল্পের টেকনিশিয়ান যেমন; ফ্যাব্রিকেশন, ইলেকট্রিক, প্লাম্বিং, ওয়েল্ডিং এধরনের অসংখ্য কাজের জন্যে উপযুক্ত প্রশিক্ষিত শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছেনা। মোটরগাড়ির গ্যারেজ, কাঠের কাজ, স্টীল ওয়ার্কস, ইলেকট্রনিক্সসহ বিভিন্ন মেরামতি কাজে এখনো সনাতনী কায়দায় অশিক্ষিত বা অতি অল্পশিক্ষিত কর্মীরা গুরু-পরম্পরায় হাতে কলমে শেখা অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করে চলছে। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা প্রায় একইভাবে দক্ষ ও বিশ্বস্ত কর্মীর অভাবের অভিযোগ করেন।
সবার চাই একটা সরকারি চাকুরী। সেটা ক্লিনার, দারোয়ান, পিয়ন কেরানী যা-ই হোক না কেন ! ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা অসংখ্য প্রাইভেট ও পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রতিবছর কয়েক লক্ষ মানহীন গ্র্যাজুয়েট বের হয়ে বেকারের সংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে বিপুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দেশ-বিদেশের শ্রম-বাজারে টেকনিক্যাল শ্রমশক্তির যোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
পত্রিকান্তরে দেখেছিলাম, ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই বাজেটে টেকনিক্যাল শিক্ষাখাতে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও বরাদ্ধের দাবী জানিয়েছে। শিক্ষাখাতে বরাদ্ধ বেড়েছে কিন্তু তাঁদের প্রয়োজনীয়তাবোধ থেকে সৃষ্ট এ দাবীর বিষয়ে সরকার নতুন কি পদক্ষেপ নিচ্ছে সেটা দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান, নার্সিং ও হসপিটালিটি সেবার জন্যে উপযুক্ত কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না।
সমস্যাগুলো সমাধানে আশু ব্যবস্থাগ্রহন এমন জটিল কিছু নয়। বিশেষ করে ইউজিসি থেকে নতুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল ও বিশেষায়িত ছাড়া নন-এপ্লাইড সাধারন শিক্ষার অনুমোদন না দেয়া। ইতোমধ্যে প্রদত্ত অনুমোদন মূল্যায়ন করে অপ্রয়োজনীয় বিষয বাতিল করা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় / কলেজে অপ্রায়োগিক সাবজেক্ট এর সিট সংখ্যা কমিয়ে দেয়া ও নতুন নতুন প্রায়োগিক বিষয অন্তর্ভুক্ত করা। ১০-১২তম গ্রেড পাশ করার পর টেকনিক্যাল /ভোকেশনাল শিক্ষার্থী তৈরিতে প্রণোদনা দেয়া। দেশে ব্যাপক সংখ্যক ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট তৈরী করা। সাধারন উচ্চশিক্ষার অবারিত সহজ সুযোগের রাশ টেনে ধরে মধ্যস্তরেই কর্ম-উপযোগি দক্ষ জনশক্তি তৈরী করা। শিক্ষার প্রতিটি-স্তরে উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিচারে ডিপ্লোমা/ডিগ্রীর মূল্যায়ন করা।
নির্মাণ ও ফ্যাব্রিকেশন শিল্পের সাথে কাজ করতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই টের পেয়েছি দক্ষ শ্রমিকের কি মারাত্মক অভাব ! উল্টা-দিকে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিন্মমানের কাজ, সময় ও অর্থের অপচয়, ভোগান্তি, কমিটমেন্টের অভাব এসব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকগণ যদি দয়া করে বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেখতেন !